সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৫:২০ পূর্বাহ্ন
২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেট পেশ বৃহস্পতিবার। এ নিয়ে টানা দশমবারের মতো বাজেট ঘোষণা করে রেকর্ড গড়বেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। এবারই প্রথম সবপক্ষকে খুশি করার চেষ্টা করবেন তিনি। আগের বাজেটগুলোর প্রাপ্তি সবার প্রত্যাশার সঙ্গে মিলত না। এবার সেটা হওয়ার সম্ভাবনা কম। কারণ একটাই, সামনে নির্বাচন। সবাইকে খুশি করে আগামী নির্বাচনে ভোটের পাল্লা ভারী করতে চায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। প্রস্তাবিত বাজেটকে তাই ভোটার তুষ্টির বাজেট বলছেন বিশ্লেষকরা।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাজেট ঘোষণার পর সবার কমন অভিযোগ থাকে করহার নিয়ে। এবার নতুন করে কোনো কর বসানো হবে না বলে আগেই জানিয়ে দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। এর বাইরে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় আনা হচ্ছে রেকর্ড পরিমাণ হতদরিদ্রকে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ বেকরকারি খাতের চাকরিজীবীদের খুশি করতেও ঘোষণা আসতে পারে। বেসরকারি চাকরিজীবীদের জন্য পেনশনের ঘোষণাও থাকতে পারে। স্বস্তি পেতে পারেন ব্যবসায়ীরাও। ভ্যাটের প্রক্রিয়া সহজ করার ঘোষণা দেবেন মুহিত। নতুন বাজেটে এক উচ্চাভিলাষী জিডিপির (মোট দেশজ উৎপাদন) প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে চায় সরকার। এরই আলোকে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলন ধরা হচ্ছে ৭ দশমিক ৮ শতাংশ। এ ছাড়া সরকার নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায় দ্রব্যমূল্যের দাম। মূল্যস্ফীতির হার ৫ দশমিক ৬ শতাংশে ধরে রাখার চিন্তা করা হচ্ছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, নির্বাচনের আগে সরকারি চাকরিজীবীসহ ভোটার সন্তুষ্ট করার পথে হাঁটছেন অর্থমন্ত্রী। নিয়েছেন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নানা উদ্যোগ। এরই অংশ হিসেবে আসন্ন বাজেটে সাধারণ মানুষের ওপর নতুন কোনো করের বোঝা চাপাচ্ছেন না তিনি। সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য চালু করা হচ্ছে গৃহনির্মাণ ঋণ কর্মসূচি। এ খাতে প্রথমবারের মতো রাখা হচ্ছে গৃহনির্মাণ ঋণের সুদ পরিশোধ বাবদ ১৩ হাজার ৫৩০ কোটি টাকা। এটি বেতন-ভাতার বাইরে অতিরিক্ত বরাদ্দ, যা ১ জুলাই থেকে কার্যকর হওয়ার কথা। থাকছে সার্বজনীন পেনশন (সবার জন্য পেনশন) পদ্ধতির একটি রূপরেখা।
রাজস্ব আদায়
২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে মোট রাজস্ব প্রাপ্তির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, ৩ লাখ ৩৯ হাজার ২৮০ কোটি টাকা, যা চলতি (২০১৭-১৮) অর্থবছরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৫১ হাজার ২৯০ কোটি টাকা বেশি। আর সংশোধিত বজেটের চেয়ে ৭৯ হাজার ৪৫৪ কোটি টাকা বেশি। রাজস্ব আদায়ের এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা হবে নতুন কোনো করারোপ ছাড়াই। করের আওতা বাড়িয়ে এ টার্গেট পূরণ হবে বলে অর্থ মন্ত্রণালয় ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা গেছে।
নতুজ বাজেটে ৩ লাখ ৩৯ হাজার ২৮০ কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) নিয়ন্ত্রিত কর থেকে দুই লাখ ৯৬ হাজার ২০১ কোটি টাকা, এনবিআর-বহির্ভূত করব্যবস্থা থেকে ৯ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা এবং কর ছাড়া প্রাপ্তি—যেমন টোল, সরকারি হাসপাতালের ফিসহ অন্যান্য উৎস থেকে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৩ হাজার ৩৫২ কোটি টাকা।
চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের টার্গেট নির্ধারিত হয়েছিল ২ লাখ ৮৭ হাজার ৯৯০ কোটি টাকা, পরবর্তীতে তা সংশোধন করে দুই লাখ ৫৯ হাজার ৪৫৪ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়। চলতি বছরের মূল বাজেটে এনবিআরকে লক্ষ্যমাত্রা দেয়া ছিল দুই লাখ ৪৮ হাজার ১৯০ কোটি টাকা, সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে ২ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা করা হয়।
সূত্র জানায়, প্রতি অর্থবছর বছরের শুরুতে বিশাল রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নেয়া হলেও শেষ দিকে তা কমিয়ে আনা হয়। কমিয়ে আনায় গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পেরেছে এনবিআর।
বাজেট ঘাটতি
নতুন করে করারোপ না করায় ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে চাহিদা মেটাতে অর্থমন্ত্রীকে বড় অঙ্কের ঘাটতি রেখে বাজেট প্রণয়ন করতে হচ্ছে। নতুন অর্থবছরে সামগ্রিক বাজেট ঘাটতি রাখা হচ্ছে এক লাখ ২৫ হাজার ২৯৩ কোটি টাকা। এটি মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৪ দশমিক ৯ শতাংশ। অবশ্য বাজেটে চার হাজার ৫১ কোটি টাকা বৈদেশিক অনুদান পাওয়ার আশা থাকছে। ওই অনুদান পাওয়া গেলে ঘাটতি দাঁড়াবে এক লাখ ২১ হাজার ২৪২ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৪ দশমিক ৭ শতাংশ।
এ ঘাটতি মেটাতে অর্থমন্ত্রী বৈদেশিক উৎস থেকে মোট ঋণ নেবেন ৬০ হাজার ৫৮৫ কোটি টাকা। সেখান থেকে ১০ হাজার ৫৬৯ কোটি টাকা বিদেশি ঋণ পরিশোধে খরচ হবে। ফলে সরকারের নিট বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে ৫০ হাজার ১৬ কোটি টাকা। ঘাটতির বাকি ৭১ হাজার ২২৬ কোটি টাকা নেয়া হবে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে। এর মধ্যে ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া হবে ৪২ হাজার ২৯ কোটি টাকা, সঞ্চয়পত্র থেকে নেয়া হবে ২৬ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা। বাকি তিন হাজার কোটি টাকা অন্যান্য উৎস হতে।
চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে নিট বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ধরা হয়েছিল ৪৬ হাজার ৪২০ কোটি টাকা, সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে ৪১ হাজার ৫৬৭ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়। গত অর্থবছরের মূল বাজেটে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ৬০ হাজার ৩৫২ কোটি টাকা নিয়ে ঘাটতি মেটানোর কথা বলা হয়েছিল। সংশোধিত বাজেটে এটি বাড়িয়ে ৬৬ হাজার ১৭ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়। মূল বাজেটে ব্যাংক থেকে ২৮ হাজার ২০৩ কোটি টাকা, সঞ্চয়পত্র থেকে ৩০ হাজার ১৫০ কোটি টাকা নেয়ার লক্ষ্য ছিল। তবে অর্থবছরজুড়ে অধিক হারে সঞ্চয়পত্র বিক্রি হওয়ায় সংশোধিত বাজেটে এ খাত থেকে ৪৪ হাজার কোটি টাকা এবং ব্যাংক থেকে ১৯ হাজার ৯১৭ কোটি টাকা নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় সংশোধিত বাজেটে।
চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছিল এক লাখ ১২ হাজার ২৭৬ কোটি টাকা, সংশোধিত বাজেটে তা সামান্য কমিয়ে নানানো হয় এক লাখ ১২ হাজার ৪১ কোটি টাকায়। উভয় ক্ষেত্রেই এই ঘাটতির পরিমাণ জিডিপির ৫ শতাংশ।
জিডিপি প্রবৃদ্ধি
আগামী অর্থবছরে এক উচ্চাভিলাষী জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে চায় সরকার। এরই আলোকে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলন ধরা হচ্ছে ৭ দশমিক ৮ শতাংশ। টাকার অঙ্কে জিডিপি হবে ২৫ লাখ ৩৭ হাজার ৮৪৯ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে যা ছিল ২২ লাখ ২৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে সেটাকে বাড়িয়ে ২২ লাখ ৩৮ হাজার ৪৯৮ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সরকার আশা করছে নতুন অর্থবছরে দেশে বড় ধরনের কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ হবে না। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাও থাকবে বলে মনে করা হচ্ছে। একই সঙ্গে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিও স্বাভাবিক থাকবে। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়বে না, জিনিসপত্রের দামও থাকবে স্থিতিশীল। ফলে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ৭ দশমিক ৮ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন খুব বেশি দুরূহ হবে না।
ভ্যাট ভোগান্তি কমছে
প্রস্তাবিতব্য বাজেটেই ভ্যাট হারে ব্যাপক পরিবর্তন আসতে পারে। বর্তমানে নয়টি ভ্যাট হার আছে। এটি কমিয়ে ছয়টি হারে নামানো হতে পারে। বর্তমানে দেড়, আড়াই, ৩, ৪, সাড়ে ৪, ৫, ৬, ১০ ও ১৫ এই ৯টি হারে ভ্যাট আদায় করা হয়। সংকুচিত ভিত্তিমূল্যে গণনা করা হয় এসব হার।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, এই হার হতে পারে ২, ৩, ৪, ৬, ১০ ও ১৫ শতাংশ। অন্যদিকে অগ্রিম ব্যবসায় ভ্যাট (এটিভি) ১ শতাংশ বাড়িয়ে ৫ শতাংশ করা হতে পারে।
মূল্যস্ফীতি
নতুন অর্থবছরের বাজেটে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ রাখার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরের মূল্যস্ফীতি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৫ দশমিক ৫ শতাংশ, তবে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বাড়ায় সংশোধিত বাজেটে তা কিছুটা বাড়িয়ে ৫ দশমিক ৮ শতাংশে উন্নীত করা হয়।
Leave a Reply