সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৫:২১ পূর্বাহ্ন
আগামী সপ্তাহ থেকে প্রার্থী বাছাইয়ের প্রক্রিয়া শুরু করতে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ। এরই মধ্যে জোটের শরিকদের চাহিদা ২০০ আসনের বেশি। যদিও সরকারি দলের উচ্চপর্যায়ের সূত্র বলছে, আওয়ামী লীগ নিজের জন্য ২০০ আসন রাখার পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে। বাকি ১০০ আসন জাতীয় পার্টি, ১৪ দলের শরিক, ধর্মভিত্তিক দলসহ অন্য মিত্রদের দেওয়ার চিন্তা করছে।
শুক্রবার সন্ধ্যায় গণভবনে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদ, সংসদীয় দল ও উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক হয়েছে। এই বৈঠকের পর ১৪ দলের শরিক, জাতীয় পার্টিসহ অন্য নির্বাচনী মিত্রদের সঙ্গে বৈঠক করবে আওয়ামী লীগ।
জোট সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোটের শরিকেরা নিজ নিজ দলের কারা কারা প্রার্থী হতে পারেন, এর প্রাথমিক তালিকা করেছে। কোনো কোনো দল অনানুষ্ঠানিকভাবে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে তালিকা জমাও দিয়েছে।
শরিকদের প্রাথমিক তালিকা অনুযায়ী, ১১টি দল ১৪৩টি আসনে নিজেদের প্রার্থী ঠিক করেছে। এইচ এম এরশাদের জাতীয় পার্টি ৮০ আসন চায়। এর বাইরে ধর্মভিত্তিক কিছু দলকে পাশে পেতে এবং বিএনপি-জোটের কাউকে কাউকে বের করে আনার তৎপরতা আছে। ফলে আসন চাহিদা আরও কিছু বাড়বে।
তবে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো এ-ও বলছে, বিএনপি নির্বাচনে আসবে এটা ধরে নিয়েই সরকারি দল কৌশল ঠিক করছে। বিএনপি নির্বাচনে না এলে আওয়ামী লীগ ১৪-দলীয় জোট নিয়ে একসঙ্গে ভোট করবে। জাতীয় পার্টিসহ বাকি মিত্রদের সঙ্গে নির্বাচনী জোট হবে না। তবে অনানুষ্ঠানিক সমঝোতা থাকবে।
আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র বলছে, দলের বর্তমান মন্ত্রী-সাংসদদের মধ্যে জিততে পারেন—এমন ১০০ জনের তালিকা ইতিমধ্যে চূড়ান্ত করা হয়েছে। আর ১০০ আসনে নতুনদের প্রাধান্য দেওয়ার পরিকল্পনা আছে। ইতিমধ্যে দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা একটা খসড়া তৈরি করেছেন। তবে প্রতীক বরাদ্দ দেওয়ার আগ পর্যন্ত যেকোনো আসনে প্রার্থী বদল হতে পারে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর ও মনোনয়ন বোর্ডের সদস্য কাজী জাফরউল্যাহ প্রথম আলোকে বলেন, আওয়ামী লীগের প্রার্থী বাছাইয়ে তৃণমূলের মতামত নেওয়া শুরু হবে খুব শিগগির। তবে প্রার্থী চূড়ান্ত করার বিষয়টি নির্ভর করবে জোট-মহাজোটের ওপর। তফসিল ঘোষণার পর প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সেই সুযোগ থাকছে। ফলে শেষ কথা বলার সময় এখনো অনেক বাকি আছে।
শরিকদের প্রত্যাশা-প্রাপ্তি নিয়ে আলোচনা
১৪ দলের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টি সূত্র জানায়, দলটি সারা দেশ থেকে জেলা নেতাদের বাছাই করা নাম নিয়ে ৩৭ জনের একটি প্রার্থী তালিকা করেছে। সেখান থেকে ১৫টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার আগ্রহ দেখিয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে দর-কষাকষি করবে। বর্তমানে ওয়ার্কার্স পার্টির সংসদ সদস্য আছেন ছয়জন। দলের সভাপতি রাশেদ খান মেনন এখন সমাজকল্যাণমন্ত্রী।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সংসদ সদস্য ছিলেন পাঁচজন। দলের সভাপতি হাসানুল হক ইনু তথ্যমন্ত্রীর দায়িত্বে আছেন। গত বছর দলটি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এক অংশের সভাপতি হাসানুল হক ইনু, আরেক অংশের সভাপতি শরিফ নুরুল আম্বিয়া। দুই অংশই ১৪ দলে আছে। এখন হাসানুল হক ইনুর অংশে সাংসদ আছেন তিনজন আর আম্বিয়ার অংশে দুজন।
দুই জাসদের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দুই পক্ষই মনে করছে, জোট থেকে যে অংশে বেশি আসন আদায় করতে পারবে, তারাই দলের নেতা-কর্মীদের বড় অংশ পক্ষে নিতে পারবে। হাসানুল হক ইনুর জাসদ ইতিমধ্যে ২৫টি আসনে প্রার্থী বাছাই করেছে। এই তালিকা ধরে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আলোচনায় বসবে। আর শরিফ নুরুল আম্বিয়ার নেতৃত্বাধীন অংশ ১৮ জনের একটি প্রার্থী তালিকা করেছে। এই অংশ ‘বাংলাদেশ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল’ নামে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধনের আবেদন করেছে। কিন্তু এখনো তা পায়নি।
এই দুই দলের বাইরে বর্তমান সংসদে তরীকত ফেডারেশন ও আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর জাতীয় পার্টির (জেপি) দুটি করে আসন আছে। এর মধ্যে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু এখন পানিসম্পদমন্ত্রী। এবার জেপি ২৫ জনের এবং তরীকত ফেডারেশন ১৫ জনের নামের তালিকা করেছে।
তরীকত ফেডারেশনের সভাপতি নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী এবং জেপির মহাসচিব শেখ শহিদুল ইসলাম দুজনই প্রাথমিক তালিকা তৈরির কথা জানিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, জোটের বৈঠকে বিষয়টি চূড়ান্ত হবে।
শরিক গণতন্ত্রী পার্টির বর্তমান সংসদে কোনো সদস্য নেই। ২০ অক্টোবর তাদের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির বৈঠক করে ১৭ জন প্রার্থীর নামের তালিকা তৈরি করেছে। তবে এই তালিকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য শহীদুল্লাহ সিকদারের নামও রয়েছে। তিনি আবার দলের সংসদীয় বোর্ডেরও প্রধান। দলেরই একটা অংশ মনে করছে, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে নির্বাচন করা এবং বোর্ডের প্রধান থাকা নিয়ে দলের ভেতর সমালোচনা আছে।
সাম্যবাদী দল ছয়টি আসনে মনোনয়ন চাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে জোট গঠনের পর ২০০৮ ও ২০১৪ সালের নির্বাচনে এ দলের কেউ মনোনয়ন পাননি। তবে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের মন্ত্রী ছিলেন সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া। এবারও দিলীপ বড়ুয়ার আসনটিই তাদের মূল লক্ষ্য।
কমিউনিস্ট কেন্দ্রের আহ্বায়ক ওয়াজেদুল ইসলাম খান ও যুগ্ম আহ্বায়ক অসিত বরণ রায়ের জন্য দুটি আসন চাওয়া হবে। অসিত বরণের বাড়ি গোপালগঞ্জে। আর ওয়াজেদুল ইসলাম খান তেজগাঁও শিল্প এলাকায় নির্বাচন করতে চান। তবে ১৪ দলের নেতারা বলছেন, দুটি আসনের দাবি পূরণ করা আওয়ামী লীগের জন্য কঠিন।
আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, ১৪ দলের শরিকদের মধ্যে চার-পাঁচটা দল ছাড়া অন্যদের আসন পাওয়ার সম্ভাবনা কম। ক্ষমতায় গেলে তাদের অন্যভাবে পুষিয়ে দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হবে।
জাপা বড় দাবিদার, আরও দল আছে
জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ গত ৯ সেপ্টেম্বর সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ সময় তিনি ৮০টি আসনের দাবি করেন বলে দলীয় সূত্র থেকে জানা গেছে। তবে ওই দিন প্রধানমন্ত্রী তাঁকে কোনো কথা দেননি। জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান ও সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদের সঙ্গে আলাপ করে পরে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা বলেন। পরে রওশন এরশাদের সঙ্গেও অনানুষ্ঠানিক কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী রওশন এরশাদের মতামতকে গুরুত্ব দিতে চান। জাতীয় পার্টির ৪০-৪৫টি আসনের বেশি পাওয়ার সম্ভাবনা নেই।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী ছিল ৮৬ আসনে। জয়ী হন ৩৪ প্রার্থী। এর আগে ২০০৮ সালের নির্বাচনে মহাজোটের অংশ হিসেবে ভোট করেছিল। তখন জাতীয় পার্টি ২৭টি আসন পায়।
এর বাইরে বিএনপি জোট থেকে কোনো কোনো দলকে বের আনার পরিকল্পনা আছে সরকারের। সম্ভাব্য এমন একটি দলের প্রধান নিজে ও তাঁর ছেলের জন্য দুটিসহ ১২ আসন চান বলে জানা গেছে। প্রায় একই রকম চাহিদা প্রয়াত মাওলানা ফজলুল হক আমিনীর ইসলামী ঐক্যজোটেরও। তবে তাদের দুটি আসনের ব্যাপারে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে। তাদের ধারণা, শেষ পর্যন্ত হয়তো একটিতে সন্তুষ্ট থাকতে হবে।
নাজমুল হুদার বিএনএ (বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট অ্যালায়েন্স), আবুল কালাম আজাদের বিএনএফ (বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট) একটি করে আসন চাইছে। এ ছাড়া সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, নারী প্রার্থী, ব্যবসায়ী, সাবেক সামরিক-বেসামরিক আমলা, পেশাজীবী, খেলোয়াড়—এমন কিছু শ্রেণি-পেশার ব্যক্তিও বিশেষ বিবেচনায় থাকবেন বলে জানা গেছে।
আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায়ের সূত্রগুলো বলছে, দলের কে কোন আসনে মনোনয়ন পাবেন, জোটের শরিকদের কে কত আসন পাচ্ছেন—এটা চাওয়ার ওপর খুব একটা নির্ভর করছে না। এটা অনেকটাই নির্ভর করছে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার ওপর। তিনি বিভিন্ন সংস্থা ও দলের অভ্যন্তরীণ জরিপ বিবেচনা করে মনোনয়ন চূড়ান্ত করবেন বলে এর আগে বিভিন্ন দলীয় বৈঠকে বলেছেনও।
Leave a Reply