সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:০৩ পূর্বাহ্ন
বিপিওর ‘শান্তি পরিস্থিতি ২০১৮’ শীর্ষক প্রকাশনা
* সহিংস ঘটনার সঙ্গে রাজনৈতিক দল জড়িয়ে পড়ছে
* রাজনৈতিক দলের ভূমিকা পুনর্মূল্যায়ন করার সময় এসেছে
সহিংস যেকোনো ঘটনার সঙ্গে রাজনৈতিক দল ও দলের কর্মীরা জড়িয়ে পড়ছে। গত বছর দেশে ১ হাজার ৯০৫টি রাজনৈতিক সহিংস ও অহিংস ঘটনা ঘটেছিল। অধিকাংশ ঘটনায় সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলো সরাসরি জড়িত ছিল। গবেষকেরা বলছেন, সমাজে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে হলে রাজনৈতিক দলের ভূমিকা পুনর্মূল্যায়ন করার সময় এসেছে। রাজনীতি চর্চার সর্বস্তরে গণতন্ত্র ও অহিংস আচরণকে ভিত্তি বলে মেনে নিতে হবে।
বাংলাদেশ পিস অবজারভেটরির (বিপিও) ‘শান্তি পরিস্থিতি ২০১৮’ শীর্ষক প্রকাশনায় এই কথা বলা হয়েছে। গবেষকেরা বলছেন, সরকার সময়মতো পদক্ষেপ নেওয়ায় দেশে সন্ত্রাসবাদের রাশ টেনে ধরা সম্ভব হয়েছে। বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান তাই প্রতিবেশী দেশগুলোর চেয়ে ভালো। তবে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আরও কিছু করা দরকার। বৈশ্বিক শান্তি সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান গত দুই বছরের তুলনায় খারাপ হয়েছে।
সূত্র: বাংলাদেশ পিস অবজারভেটরি (বিপিও)জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) সহায়তায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ ‘পার্টনারশিপস ফর আ টলারেন্ট অ্যান্ড ইনক্লুসিভ বাংলাদেশ’ নামের একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। সেই প্রকল্পের একটি অংশ বিপিও। উন্মুক্ত উপাত্তের মাধ্যমে শান্তি ও সহিষ্ণুতা সম্পর্কে ধারণা পেতে কাজ করছে বিপিও। ১৯টি জাতীয় ও আঞ্চলিক দৈনিক সংবাদপত্র থেকে নেওয়া তথ্য এই প্রকাশনায় ব্যবহার করা হয়েছে। স্টপ ভায়োলেন্স কোয়ালিশন, বাংলাদেশ পুলিশ, ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজ, অ্যাকশনএইড, দ্য সোসাইটি ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট এবং জাতীয় ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টার বিপিওর সঙ্গে যুক্ত আছে। প্রকাশনাটি সম্পাদনা করেছেন সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের প্রতিষ্ঠানা অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ।
প্রকাশনায় দেশের নারীর প্রতি সহিংসতা, রাজনৈতিক সহিংসতা, সন্ত্রাসবাদ, সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংসতার ওপর বেশি জোর দেওয়া হয়েছে। প্রকাশনার সম্পাদক পরিষদের সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক দেলওয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘শান্তি সকলের কাম্য। শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সন্ত্রাস দমন বা সহিংসতা কমানোই একমাত্র পন্থা নয়। মানুষকে সহিষ্ণু হতে হবে, রাষ্ট্রকে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে।’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘সন্ত্রাসবাদ কমলেও সহিংসতা না কমার বড় কারণ হচ্ছে সামাজিক অবক্ষয় ও অসচেতনতা। আর এই অবস্থা পরিবর্তনে শুধু সরকারকে ভূমিকা রাখলে চলবে না, সামাজিক নেতাদেরও এগিয়ে আসতে হবে। মাদক সমস্যা বা বাল্যবিবাহ সমস্যা আমাদের একার পক্ষে দূর করা সম্ভব নয়। তেমনি অপরাধ করাও আমরা একা বন্ধ করতে পারব না। এ ছাড়া পারিবারিকভাবেও সচেতনতা বাড়াতে হবে, আমাদেরকে সহায়তা করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।’চট্টগ্রামের পটিয়ায় নির্বাচনী সহিংসতায় প্রাণ হারান আবু সাদেক নামের একজন। ছেলের মৃত্যুর খবর শুনে মা সুলতানা বেগমের আহাজারি। পটিয়া, চট্টগ্রাম, ৩০ ডিসেম্বর। ছবি: জুয়েল শীল
রাজনৈতিক সহিংসতা: ২০১৮ সালে দেশে ১ হাজার ৯৩টি রাজনৈতিক সহিংস ঘটনা ঘটে। এতে ১৭৫ জনের মৃত্যু হয়, আহত হয় ৬ হাজার ৫৯৪ জন। এসব ঘটনায় ৮৯২ জন গ্রেপ্তার হয়। এই সময় ৮১২ অহিংস রাজনৈতিক ঘটনায় ৬ হাজার ২০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।
রাজনৈতিক দলের সম্পৃক্ততা খুঁজতে গিয়ে দেখা গেছে, আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিএনপির সংঘর্ষ হয়েছে ১৪৮টি, আওয়ামী লীগের সঙ্গে অন্য দলের সংঘর্ষ ১৮টি, বিএনপির সঙ্গে অন্য দলের সংঘর্ষ ৩১টি। গত বছর রাজনৈতিক ঘটনা (সহিংস ও অহিংস) সবচেয়ে বেশি ঘটেছিল চট্টগ্রাম। মোট ২৪৬টি ঘটনা ওই বিভাগে ঘটে। ঢাকায় ঘটেছিল ২২০টি ঘটনা।
এসব ঘটনার পেছনের কারণ বা চালিকাশক্তি চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছেন গবেষকেরা। তাঁরা দেখেছেন, ২৪.৮ শতাংশ ঘটনা ছিল নির্বাচনকেন্দ্রিক। ১৪.২ শতাংশ ঘটনার পেছনে আছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যকার উত্তেজনা। এবং ১৪ শতাংশের কারণ দলগুলোর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব। এ ছাড়া রাজনৈতিক অন্যান্য বিষয়ের কারণে ১২ শতাংশ ঘটনা ঘটেছিল।
একাদশ সংসদ নির্বাচনের ৫০২টি সহিংস ও ১১৭টি অহিংস ঘটনার তথ্য প্রকাশনায় আছে। এতে সম্পদ লুটতরাজ ও ধ্বংসের ১৩৭টি ঘটনার তথ্য আছে। এসব ঘটনায় নিহত হয় ৪০ জন এবং আহত হয় ৩ হাজার ৪০১ জন।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘মুখোমুখি অবস্থানে থাকা প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর আচরণও সাধারণ মানুষকে আতঙ্কে রেখেছে। দেশে নির্বাচন বা সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতি বিরাজমান না হলেও মানুষের মনে শান্তি নেই। আমিও গবেষকদের সঙ্গে একমত যে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনা দরকার। রাজনীতিকদের আরও সহনশীল ও পরমতসহিষ্ণু হওয়া উচিত।’
সহিংস চরমপন্থা: গত বছর চরমপন্থার ৬৫ শতাংশ ঘটনার সঙ্গে জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) সম্পর্ক ছিল বলে বিপিওর বিশ্লেষণে বেরিয়ে এসেছে। এই সময়ে সারা দেশে ১৩৪টি ঘটনা ঘটে। সবচেয়ে বেশি ঘটনা ছিল ঢাকায়, মোট ৪৬টি। এরপর ছিল রাজশাহী ও রংপুর জেলায়। ওই দুই জেলায় যথাক্রমে ৩৭ ও ৩০টি ঘটনার তথ্য বিপিও পেয়েছে।
এই সময় ১২০টি ঘটনায় মোট ৩২২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর মধ্যে র্যাব গ্রেপ্তার করেছিল ১৪৬ জনকে।
মোট ঘটনার ৮০টির সঙ্গে জেএমবি বা নব্য জেএমবির সম্পর্ক ছিল। এসব ঘটনার মধ্যে ছিল ৪টি বন্দুকযুদ্ধ, ২টি আত্মহত্যা ও ৭৪টি গ্রেপ্তারের ঘটনা। এসব ঘটনায় ৯ জনের মৃত্যু হয়, আহত হয় ২ জন ও গ্রেপ্তার হয় ২৫০ জন।
সংখ্যালঘুর নিরাপত্তা: গত বছর ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর ৮০টি সহিংস ঘটনা ঘটেছে। সবচেয়ে বেশি (১৮টি) ঘটনা ঘটে রংপুর বিভাগে। এরপর রাজশাহী (১৭) ও ঢাকা (১৪) বিভাগে। এসব ঘটনায় ১৪ জনের মৃত্যু হয়, আহত হয় ৬২ জন। যৌন নির্যাতনের ৭টি ঘটনা ঘটে।
এসব ঘটনার মধ্যে আছে ৩৫টি মন্দিরে আক্রমণ, ৫৫টি মূর্তি ভাঙচুর ও ২৩টি বাড়ি আক্রমণ।
২০১১ সালের আদমশুমারির পরিসংখ্যান তুলে ধরে বলা হয়েছে, দেশের মোট জনসংখ্যার ৮.৫ শতাংশ হিন্দু। বৌদ্ধ, খ্রিষ্ট ও অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘু যথাক্রমে ০.৬, ০.৩ ও ০.১ শতাংশ।
পরিবারে নারী অনিরাপদ: নারীর প্রতি সহিংসতায় মৃত্যুর ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটছে পরিবারে। পারিবারিক সহিংসতায় নারীর বেশি মৃত্যু হচ্ছে স্বামীর হাতে। প্রতিবেদনের এই অংশটুকুর লেখক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক আমেনা মোহসিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘নারীর প্রতি সহিংসতার বর্তমান ধারা বা প্রবণতা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। নিরাপদে থাকবে এই বিবেচনায় মেয়েকে বিয়ে দেওয়া হয়। আমাদের পরিসংখ্যান বলছে, স্বামীর ঘরেই নারী সবচেয়ে অনিরাপদ।’
পারিবারিক নির্যাতন, যৌতুক সংশ্লিষ্ট নির্যাতন ও যৌন নির্যাতনের ঘটনার তথ্য বিশ্লেষণ করেছেন গবেষকেরা। পারিবারিক নির্যাতনের ২৯১টি ঘটনায় ২২৬ নারীর মৃত্যু হয় এবং আহত হয় ৫৩ জন। যৌতুক–সংশ্লিষ্ট ৯৭টি নির্যাতনের ঘটনায় ৬৩ জন নারীর মৃত্যু হয় ও আহত হয় ২৮ জন নারী। যৌন নির্যাতনের ৫১২টি ঘটনায় দেখা গেছে, নির্যাতনে ৪২ নারীর মৃত্যু হয়েছে। আর আহত হয়েছে ২৮৪ জন নারী।
পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, মৃত্যুর ঘটনা বেশি ঘটছে পারিবারিক নির্যাতনে ও যৌতুকের কারণে। দুই ক্ষেত্রই স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির মানুষের সংশ্লিষ্টতা আছে। ঘটনার শিকার প্রায় অর্ধেক নারী আহত হয় এবং উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নারী যৌন নির্যাতনের পর মারা যায়। তবে সংখ্যার মাধ্যমে নির্যাতনের সম্পূর্ণ চিত্র ফুটিয়ে তোলা সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করছেন আমিনা মোহসিন। তিনি বলেন, ‘এর মাধ্যমে শারীরিক নির্যাতনের কিছু তথ্য পাওয়া গেলেও নির্যাতিতদের মানসিক পরিস্থিতির কিছুই জানা সম্ভব হয় না। এবং নির্যাতনের মাধ্যমে যে আতঙ্ক ছড়ায়, সে সম্পর্কেও কোনো ধারণা পাওয়া যায় না।’
শান্তি ও সন্ত্রাসে দেশের অবস্থান: অস্ট্রেলিয়ার সিডনিভিত্তিক বৈশ্বিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর ইকোনমিকস অ্যান্ড পিসের (আইইপি) বৈশ্বিক শান্তি সূচক-২০১৮-এ বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৯৩তম। তবে ২০১৬ ও ২০১৭ সালে এই তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ছিল যথাক্রমে ৮৩ ও ৮৪তম। আর গত ডিসেম্বরে আইইপি থেকে প্রকাশিত বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ সূচক-২০১৮–এ ১৬৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ২৫তম।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ড. এম সাখাওয়াত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সন্ত্রাসবাদ দমনে কঠিন অবস্থান নিয়ে সরকার গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছে। কিন্তু উগ্র সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ছাড়াও মানুষের শান্তি বিঘ্নিত হতে পারে। যদি গুম হওয়ার ভয় থাকে, মানুষ যদি বিনা কারণে গ্রেপ্তার হয়, তাহলে শান্তি বিনষ্ট হয়। মাদকবিরোধী অভিযানে নিরপরাধ মানুষ মারা গেলে শান্তি নষ্ট হবে।
Leave a Reply