সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৫:৪০ পূর্বাহ্ন
ইংরেজি মাস ডিসেম্বরের সবটুকু জুড়ে থাকে বাংলা সনের পৌষ আর মাঘ মাস। থাকে প্রচ- শীত আর তীব্র শৈত্যপ্রবাহ যা এ দেশের গ্রামীণ জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে তোলে। এবার এই শীত যতই এগিয়ে আসবে রাজনীতির বলয় ততই উত্তপ্ত হয়ে উঠবে। কারণ এটাই হবে—বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের শেষ শীত। আর এই পৌষের শীতেই হতে চলেছে বাংলাদেশের ১৬ কোটি জনমানুষের আগামী পাঁচ বছরের জন্য ভাগ্য নির্ধারণ। একাত্তরে দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের পর এ মাসেই আমরা সুদিনের সন্ধান পেয়েছিলাম। তারপর থেকে আমরা বারবার আশায় বুক বেঁধেছি, দুর্দিনের দুঃস্বপ্ন কাটিয়ে নতুন ঊষার আলো দেখতে চেয়েছি বারবার। এবারও সেই সুন্দর আগামীর স্বপ্ন দেখতে চায় এ দেশের মানুষ। যার ৪৭ বছর কেটে গেছে শুধু ক্ষমতার লড়াই আর রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব প্রত্যক্ষ করে। এই পৌষ মাস অনেক সম্ভাবনার মাস। বিজয়ের মাস। তারপরও প্রবাদ আছে ‘কারও পৌষ মাস, কারও সর্বনাশ।’ শীত মৌসুমকে পটভূমি করেই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচনা করেছিলেন তার কবিতাটি ‘সামান্য ক্ষতি’। এই কবিতায় রবিঠাকুর কাশীর মহিষী করুণার এক শীতের সকালের স্নানের বর্ণনা দিয়েছেন এইভাবে : শীতের সকালে স্বচ্ছ সলিলা বরুণার তীর ধরে—
‘…স্নানে চলেছেন শতসখীসনে
কাশীর মহিষী করুণা’
প্রবল পরাক্রান্ত রাজার সহধর্মিণী, চঞ্চুলা রানী করুণা তার খেলাচ্ছলে নদীতীরে বসবাসকারী দরিদ্র প্রজাদের পর্ণ কুটিরে আগুন জ্বালিয়ে দিতে আদেশ দিলেন। তিনি তার সহচরীদের বললেন :
‘উহু! শীতে মরি
সকল শরীর উঠিছে শিহরী
জ্বেলে দে আগুন ওলো সহচরী—
শীত নিবারিব অনলে।’
হতদরিদ্র প্রজাদের ঘরবাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে গেল। আর খেয়ালি রানী ও তার সহচরীরা শীতের প্রকোপ কাটিয়ে আনন্দ উৎসবে উচ্ছল হয়ে উঠল। তখন ছিল রাজতন্ত্র, গণতন্ত্র নয়। তবু মহৎ শাসনে ব্রতী রাজা রানীকে কঠিন সাজা দিয়েছিলেন। গরিব প্রজাদের ঘরবাড়ি নির্মাণ করে কল্যাণ সাধন করেছিলেন তিনি, তুলে ধরেছিলেন সেই আদর্শকে যা আজকের দিনের গণতন্ত্রের মর্মবাণী। গণতন্ত্র মানেই সবার সমান অধিকার ও মর্যাদার সুরক্ষা করা। এই অধিকার ও মর্যাদাকে সংরক্ষণ করে বিশ্বজনীন মানবাধিকারের নীতিসমূহ এবং আইনের দৃষ্টিতে সবার সমতা নিশ্চিত করাই গণতন্ত্রের মূল লক্ষ্য। পরিপূর্ণভাবে বিকশিত গণতন্ত্র অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রগতি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত করে সার্বিক উন্নয়নকে সম্ভব করে তোলে। আজ এ দেশে গণতন্ত্র নামমাত্র অস্তিত্ব নিয়ে টিকে আছে। নামসর্বস্ব গণতন্ত্রকে পুঁজি করে এ দেশের ক্ষমতাবান নেতৃবর্গ স্বৈরশাসকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার সুযোগ পান। রাজনীতি আজ জনকল্যাণের মাধ্যম নয়, ক্ষমতায় যাওয়ার ও আজীবন ক্ষমতায় থাকার একটি ‘শর্টকাট’ পথ।
সংবিধান অনুযায়ী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবধারিতভাবেই আসন্ন। গত ১৬ আগস্ট নির্বাচন কমিশন সচিব সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, আগামী ডিসেম্বরের শেষ অথবা জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে চলেছে। ৩০ অক্টোবর থেকে নির্বাচনের ‘কাউন্টডাউন’ শুরু হবে। অক্টোবরের শেষ অথবা নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে তফসিল ঘোষণা হবে। কমিশনের ভাষ্য অনুযায়ী ৪২ হাজার ভোটকেন্দ্রের তালিকা জেলা, উপজেলা পর্যায়ে প্রকাশ করা হয়েছে। ইতিমধ্যে সংসদ নির্বাচনের ৮০ শতাংশ প্রস্তুতি শেষ। ভোটার তালিকাও হালনাগাদ হয়ে গেছে। কারও সঙ্গে কোনা সংলাপ বা আলাপ-আলোচনার প্রয়োজন নেই। এখন শুধু নির্বাচন এবং তার জন্য অক্টোবরে গঠিত হবে নির্বাচনকালীন সরকার।
রাজনৈতিক দলসহ সব সামাজিক শক্তিও আশা করে—অবাধ, সুষ্ঠু, স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন যথাসময়েই অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু সাম্প্রতিক নাটকীয় ঘটনাবলি এই আশাকে পুরোপুরি নিরাশায় পরিণত করেছে। এই নাটকের ‘ক্লাইম্যাকস’ ঘটেছে এ বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি। ওই দিন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদ- এবং দুই কোটি টাকা জরিমানার আদেশ দিয়েছেন বিশেষ আদালত। তারপর থেকে তিনি পুরান ঢাকার পরিত্যক্ত কারাগারে নির্জন কারাবাস করছেন। এরই মধ্যে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দল এবং আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের মধ্যে কোনো সংলাপ, আলাপ-আলোচনা অথবা কোনো প্রকার সমঝোতার সম্ভাবনা দেখা যায়নি।
সময়ের প্রয়োজনে ক্ষমতাসীন ১৪ দলের বিপরীতে প্রবীণ রাজনীতিবিদ এবং সংবিধান প্রণেতা ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের অনুসরণে একটি ঐক্যপ্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এতে সাবেক বিএনপি নেতা এবং সাবেক রাষ্ট্রপতি ড. বি চৌধুরী, আ স ম আবদুর রব এবং মাহমুদুর রহমান মান্নাও যোগ দিচ্ছেন। বেগম জিয়ার মুক্তি এবং অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিকে সামনে রেখে সরকারবিরোধী জাতীয় ঐক্য সৃষ্টির প্রক্রিয়া চালাচ্ছে বিএনপির শীর্ষ নীতি-নির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটি। গত ১৩ আগস্ট সোমবার দীর্ঘ আলোচনার পর জাতীয় ঐক্যের খসড়ায় মতৈক্যে পৌঁছেছে এই ফোরাম। তা চূড়ান্ত করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে দলের মহাসচিবকে। তবে দলের নির্বাহী কমিটির সভার পরই আন্দোলনের চূড়ান্ত কর্মকৌশল নির্ধারিত হবে। আগামী মাসেই জাতীয় ঐক্যের নীলনকশা প্রকাশ্যে জনসম্মুখে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এরপর একটি সমাবেশের মাধ্যমে জাতীয় ঐক্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত জাতীয় নেতৃবৃন্দকে একমঞ্চে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নিয়ে আসার পরিকল্পনা রয়েছে।
এদিকে ১ সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে ব্যাপক শোডাউনের প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি। রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশের মাধ্যমে খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে ‘প্যাকেজ’ কর্মসূচি ঘোষণা করে বিএনপি রাজপথে নামতে চায়।
এসবের মধ্যে আওয়ামী লীগও তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন ফোরামের মাধ্যমে। গত ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস পালন উপলক্ষে দেশের ৭১ হাজার ১৯টি স্থানে আলোচনা সভা, কোরআনখানি ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করে ইসলামিক ফাউন্ডেশন। জাতীয় নির্বাচনের আগে ও পরে সম্ভাব্য নাশকতা প্রতিরোধ ও ভোটের পরিবেশ সুষ্ঠু রাখার লক্ষ্য নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীকে সহায়তার জন্য মাঠে নামবে ক্ষমতাসীন দলের লক্ষাধিক কমিটি।
স্বাভাবিক কারণেই আলাপ-আলোচনা ও প্রকাশ্য সমঝোতার মাধ্যমে আগামী নির্বাচনকে নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য করার বিষয়ে সব রাজনৈতিক দলের স্বতঃস্ফূর্ত সম্মতি ও সমর্থন যদি না আদায় করা হয় তাহলে দ্রুতচারী এবং আকস্মিকভাবে পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক ঘটনাচক্রের চাপে নির্বাচন এবং গণতন্ত্র আবারও লঘুচাপে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়বে—এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। আবার সেই স্বার্থান্বেষী নির্বাচনী প্রক্রিয়া এবং ক্ষমতার লড়াই এ দেশের গণতন্ত্রকে ষাটের দশকের আইয়ুব শাহীর মতোই পুনর্বার আমলাতান্ত্রিক চক্রজালে বন্দী করে এ দেশের সর্বনাশ ডেকে আনবে। কারণ নির্ভেজাল গণতন্ত্রই এ দেশের মানুষের বেঁচে থাকার একমাত্র সম্বল। আর তা না থাকলে এ দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বও বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা আছে।
২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারির নাটকীয় পটপরিবর্তন রাজনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির ফলে সৃষ্ট অস্থিরতা ও সংঘর্ষের নির্মম পরিণতি। তাই এই পরিবর্তনের মধ্যে সৃষ্ট এক/এগারোর সরকারের ঘোষিত উদ্দেশ্য ছিল একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রের পথযাত্রা সুগম করা। তার জন্য সংস্কার হয়েছিল নির্বাচনী আইন, বিধি ও রাজনীতির, চলেছিল জাতীয় সংলাপ। একই সঙ্গে নির্বাচনকে সুষ্ঠু, সফল ও অংশগ্রহণমূলক করার লক্ষ্যে আইনি ও মানবিক পন্থায় শীর্ষ নেতা-নেত্রীর মুক্তির ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছিল। জরুরি অবস্থা শিথিল করে অবারিত সংসদ নির্বাচনের পথ প্রশস্ত করার প্রয়াস অব্যাহত ছিল। আজ সেই প্রয়াস কোথাও পরিলক্ষিত হচ্ছে না। বরং নীতি-নির্ধারকদের কথায় ও কাজে এটা স্পষ্ট যে, সংলাপ-সমঝোতার আর কোনো সুযোগ নেই।
গত ১০ বছরে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে থেকেও রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার শোধন ও সংশোধন করা সম্ভব হয়নি বরং পরিস্থিতির অবনতিই ঘটেছে সর্বাংশে। এখন থেকে ডিসেম্বর অবধি স্বল্প সময়ে যদি সেই কাঙ্ক্ষিত শুদ্ধি সম্ভব না হয়, যদি বেগম জিয়ার মুক্তি এবং নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হয়, তাহলে এমন দিন আসতে পারে যখন ক্ষমতালোভী রাজনীতিবিদরা খেলাচ্ছলে এ দেশের জনসাধারণের পর্ণ কুটিরে আগুন জ্বালিয়ে পৌষের ‘শীত নিবারিবে অনলে।’
বাংলাদেশের জন্য এটা এক নাজুক সময়, এক সংকটময় ক্রান্তিকাল। পাঁচ বছর পর আবার সেই নির্বাচন দরজায় কড়া নাড়ছে। অথচ কেউ জানে না কাল কী ঘটতে চলেছে, আজ সবার মুখে সুস্পষ্ট চিন্তার রেখা, চোখে উদ্বেগের গভীর ছায়া। চারদিকে অনিশ্চয়তা, ছাত্র-শ্রমিকদের মনে দানাবাঁধা অসন্তোষ, বিক্ষিপ্ত বিক্ষোভ, সহিংস সংঘর্ষ। সবকিছু মিলে সরকার যেমন শঙ্কাগ্রস্ত, তেমনি জনজীবনও বিপন্ন, বিপর্যস্ত।
এই পরিস্থিতিতে আলাপ-আলোচনা, সংলাপ, তা প্রকাশ্যে অথবা গোপনে, যেভাবেই হোক না কেন, তার মাধ্যমে জাতীয় সমঝোতার ভিত্তি রচনা করতে পারলেই জাতি আরেকটি সংঘাতময় পরিণতি এড়াতে পারবে। আগামীতে দুই পক্ষের অনড় অবস্থার এক অনাকাঙ্ক্ষিত যুদ্ধাবস্থার সৃষ্টি করতে পারে, যার পরিণতি দেশ ও জাতির সামনে রয়েছে এক ভয়াবহ দুর্যোগের পূর্বাভাস। আপস সমঝোতাই বর্তমান সংকটের উত্তরণের একমাত্র পথ। দ্বন্দ্ব, সংঘর্ষ, সংশয় দূর করা এ মুহূর্তের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিরসন করে অপেক্ষমাণ মহাদুর্যোগ থেকে জাতিকে রক্ষা করার দায়িত্ব এখন সরকারের উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী ও নীতি-নির্ধারণকারী ব্যক্তিদের ওপরই বর্তায়। এতে ব্যত্যয় হলে গণতন্ত্র আবার পথভ্রষ্ট হবে। সমাজ ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতাও বিপন্ন হতে পারে। তাই রবিঠাকুরের কথা দিয়েই শেষ করি :
‘তোমার পতাকা যারে দাও
তারে বহিবারে দাও শকতি।’
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য।
Leave a Reply